
প্রকাশিত: ৩১ জুলাই, ২০২৪, ০৭:০৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী ছিল দুলাল মাহমুদ (৪০) মেধাবীও ছিল বটে। গ্রামের বাড়ীতে থেকে স্থানীয় হাইস্কুলের গণ্ডি পাড় করেছেন শিক্ষকদের সহযোগীতায়। এরপর দারুণ অর্থ কষ্টে নিজ জেলা ছেড়ে মুন্সীগঞ্জ জেলায় গিয়ে লজিং (আবাসিক শিক্ষক) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজ জীবন শেষ করেন। পরে চাকরির সন্ধানে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। সর্বশেষ বছর ১৪ আগে দেশের একটি প্রাইভেট ব্যাংকের সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বাবা-মা, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন আজিমপুর এলাকায়। কিন্তু তাদের সাজানো সুখের জীবন বেশী দিন স্থায়ী হল না।
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের চরখাগুটিয়া এলাকার বাসিন্দা সিদ্দিক খালাসীর ছেলে দুলাল মাহমুদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার সময় অফিস থেকে বাড়ী ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে গত ১৯ জুলাই শুক্রবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের চরখাগুটিয়া গ্রামের সিদ্দিক খালাসী ও জলেখা বেগম দম্পতির ৬ ছেলে এক মেয়ে। কৃষি কাজ ও দিনমজুরিই পরিবারটির জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। তাই তাদের পাঁচ ছেলে বেছে নিয়েছেন কৃষিকাজ ও দিনমজুরি দেওয়া। আর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ঐ দম্পতি। ভাইদের মধ্যে দুলাল ছিলেন চতুর্থ নম্বর। ২০০১ সালে স্থানীয় পূর্বনাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর মুন্সীগঞ্জে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। পরে ঢাকায় গিয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকুরি হয় তার। তিনি বর্তমানে ঐ ব্যাংকের কাওরানবাজার শাখায় কর্মরত ছিলেন। ৮ বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। বর্তমানে তার সংসারে ৭ বছরের আদিয়াত ও সাড়ে তিন বছরের আরিশা নামের দুটি সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী ঢাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় আজিমপুরের কলোনিতে একটি সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন পরিবার নিয়ে।
গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সন্ধ্যার সময় অফিস থেকে বাড়ী ফেরার পথে আজিমপুর এলাকায় আসলে বাম হাত আর পেটের অংশে গুলিবিদ্ধ হন দুলাল। পরে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরের দিন শুক্রবার ভোর ৬টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এরপর তার মরদেহ গ্রামের বাড়ীতে আনা হয় রবিবার বিকেলের দিকে।
নিহত দুলালের বাবা একজন কুষ্ঠ রোগী। এছাড়া মা বার্ধক্যজনিত কারনে অসুস্থ। তাই তাদের নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হতো। সেকারনে তাদের গ্রামের বাড়ী থেকে নিয়ে ঢাকায় নিজের কাছে রাখতেন দুলাল। তাদের চিকিৎসায় মাসে প্রায় ২০-৩০ হাজার টাকার মত খরচ ছিল। যা দুলাল মাহমুদের অন্যান্য ভাইদের পক্ষে চালিয়ে নেয়া দুষ্কর।
স্থানীয় বাসিন্দা রনি চৌকিদার বলেন, "দুলাল ভাই আমাদের এলাকার গর্ব। সে অনেক চড়াই উতরাই পাড় করে সফলতা পেয়েছেন। সে মারা যাওয়ায় তার পরিবারটি অভিভাবকহীন হয়ে গেলো। এখন তার অসুস্থ বাবা-মায়ের চিকিৎসা চালিয়ে নেয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি খুবই ভদ্র ও শান্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন। কখনো কোন ঝামেলায় জড়াতেন না।"
দুলালের মেঝো ভাই জসিম খালাসী বলেন, "আমার ভাই দুলাল নিজে থেকে অনেক কষ্ট করে, সংগ্রাম করে শিক্ষিত হয়েছে। কখনো দুইটা পয়সা দিয়া সাহায্য করতে পারিনি। ভালো চাকরি পেয়ে মা-বাবাকেও দেখাশোনা করছিল। নিজে সফল হয়ে আমাদের পরিবারের সুনাম বয়ে এনেছে। এভাবে লাশ হয়ে ফিরবে ভাবতে পারিনি।"
জাজিরা উপজেলার কাজীরহাট-মাঝিরঘাট সড়কের ঠিক পাশেই চরখাগুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অপর পার্শে দুটি বাড়ী পাড় হয়ে ছোট্ট একটি ফসলি জমি(বর্ষার সময় ৬ মাস নৌকা দিয়ে পাড় হতে হয়। ৩-৫ মিনিট সময় লাগে) পাড় হলেই দুলালদের বাড়ী গিয়ে দেখা যায়, দুলাল মাহমুদের নিজ আয়ের অর্থে ক্রয় করা এক খন্ড জমির একপাশে তাকে দাফন করা হয়েছে। টিনের তৈরি বসত ঘরের বারান্দায় চৌকিতে শুয়ে মা জলেখা বেগম কান্না করছেন। আর পাশেই অসুস্থ বাবা সিদ্দিক খালাসী নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছেন।
কান্না করতে করতে জলেখা বেগম বলেন, আমার ছেলেতো কখনো কারো ক্ষতি করেনি। ওরা কেন আমার বুক খালি করে আমার ছেলেকে মেরে ফেললো। আমার নাতীনাতকুরদের এতিম করে দিল। আমি এই বিচার কার কাছে চাইব?
এসময় দুলালের অসুস্থ বাবা কথা বলতে পারছেন না শুধু করুণ দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
পূর্বনাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কে. এম ইদ্রিসুর রহমান বলেন, "দুলাল মেধাবি ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিল। ওর এমন মৃত্যু মানতে পারছি না। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পাস করেছিল। আমরা শিক্ষকরা ওর পড়াশোনার ক্ষেত্রে সবসময় আর্থিক ও মানসিকভাবে সাধ্যমত সহযোগীতা করেছি। দুলাল ছোট থেকে দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শেষ করে জীবনে সফলতা পেয়েছিল। দোয়া করি আল্লাহ্ ওর মাগফেরাত দান করুক।"
বড়কান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ লুৎফর রহমান বলেন, "দুলাল জীবনে অনেক কষ্ট করে সফলতা পেয়েছে। তার এমন মুত্যু দু:খজনক। দুলাল ও তার পরিবার কোন রাজনৈতিক দলের সাথেও যুক্ত নয়। আমরা পরিষদের পক্ষ থেকে দুলালের পরিবারের সদস্যদের পাশে সবসময় থাকব।"
মন্তব্য করুন