প্রকাশিত: ২ আগষ্ট, ২০২৫, ১১:৪১ এ এম

অনলাইন সংস্করণ

সবাই এসেছে এক কাপড়হীন যাত্রায়

 

লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী


জীবনটা শুরু হয় খুবই নিরব, নিঃস্বভাবে — একফালি কাপড় ছাড়া, কিচ্ছু ছাড়াই। আমরা কেউই দুনিয়াতে কোনো সনদপত্র নিয়ে আসিনি, কোনো পদবি নিয়ে জন্মাইনি। ধনী, গরিব, নেতা, কর্মচারী, প্রভাবশালী কিংবা অবহেলিত — সবাই এসেছি একরকম করুণ, নিরাবরণ শুরুতে।

এমন এক সময় আসে, যখন মানুষ ভাবে সে অনেক কিছু — তার চাকরি আছে, ক্ষমতা আছে, পরিচিতি আছে, এবং সে চাইলেই মানুষকে চাকরি থেকে উঠিয়ে দিতে পারে, কারও জীবন ক্ষণিকেই অসহ্য করে তুলতে পারে। অথচ সে ভুলে যায় — এই সাময়িক শক্তি একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে, ঠিক যেভাবে দেহ থেকে আত্মা একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়।

আজ সমাজে আমরা এমন অনেক মুখ দেখি — যারা ধর্মের কথা বলেন, দাড়ি রাখেন, টুপি পরেন, ইসলামি রাজনৈতিক দলের পোস্টারে তাদের মুখ ঝলমল করে। কিন্তু বাস্তবে তাদের আচরণে সেই ইসলামের ছিটেফোঁটাও মেলে না। একজন ভদ্রলোক আছেন — বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। বাইরে থেকে দেখতে ভদ্র, ইসলামী আদর্শের প্রবক্তা বলেই পরিচিত। তিনি একটা ইসলামি দলের একজন নেতা, এক  বেসরকারি চাকরিও করেন। তাকে দেখে অনেকেই ভেবে বসেন, ‘এ নিশ্চয়ই একজন আদর্শবান মানুষ, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ান, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করেন’ — কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তার ব্যবহার যেন একেবারেই বিপরীত।

তার অধীনস্থ জুনিয়র কর্মকর্তারা মুখে কিছু না বললেও, অন্তরে তার প্রতি একরাশ চাপা ক্ষোভ জমে আছে। কারণ তিনি যেভাবে ছোট করেন, অপমান করেন, এবং কথায় কথায় বলেন — “চাকরি ছেড়ে দাও”, তাতে মনে হয় যেন জীবনের অর্ধেক সময় মানুষকে চাকরি দেওয়া আর ছাঁটাই করাতেই কেটে গেছে। অথচ প্রশ্ন হল — তিনি জীবনে সত্যিই কি কাউকে একটি স্বল্পপরিসরের, অন্তত একটি সুইপারের চাকরিও দিতে পেরেছেন? কারো জীবন বদলে দেওয়ার মতো কোনো দয়া, কোনো সুযোগ, কোনো সহানুভূতি কি দিতে পেরেছেন?

তার কাছ থেকে কেউ কি পেয়েছে একবারের জন্যও এমন কথা — “তুমি ভালো করছো”, “আমি পাশে আছি”, “দু’টো দিন সময় নাও”, “ভালো হয়ে যাবে”? না। তার কণ্ঠে থাকে শুধুই দাম্ভিক নির্দেশনা, চোখে তাচ্ছিল্য, মুখে অবজ্ঞা।

অথচ তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্বের অনুসারী দাবি করেন, যিনি রাসুল (সা.) — যিনি বলতেন, “তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা সদকার সামিল।” আর তিনি সেই রাসুল (সা.)—এর উম্মত, যিনি নিজের দাসকেও কখনও গালি দেননি, বরং সহানুভূতির চোখে দেখেছেন।

কোনো মানুষকে নিচু করে, ছোট করে, তার আত্মসম্মানে আঘাত করে কেউ বড় হতে পারে না। বরং এমন অহংকারই মানুষকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। মনে রাখা দরকার, আল্লাহর বিচার খুব সূক্ষ্ম। মানুষকে অপমান করলে, কারও অন্তরে কষ্ট দিলে, সেই আঘাত হয়তো আল্লাহর দরবারে সরাসরি পৌঁছে যায়।

আজ যারা বড় চেয়ারে বসে, কাল হয়তো তাদের জায়গা হবে হাসপাতালের সাদা বিছানায়, কিংবা মাটির নিচে এক গহীন অন্ধকার কবরের একাকিত্বে। তখন কে থাকবে পাশে? সেই চাকরি? সেই পদ? সেই রাজনৈতিক পরিচয়?

একটা সময় আসবে — চারপাশে কেউ থাকবে না। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। চোখদুটো চিরতরে নিঃসাড়। মুখে কোনো কথা থাকবে না, থাকবে না কোনো নির্দেশ — “তুমি চাকরি ছেড়ে দাও।” বরং থাকবে ফেরেশতার প্রশ্ন — “কে তোমার রব? কী ছিল তোমার আমল?”

এই দুনিয়া বড়ই ক্ষণস্থায়ী, অথচ তার মোহ বড়ই ভয়ংকর। জীবনে যা—ই হোক, প্রতিটি মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে — মানবিকতা, সহমর্মিতা ও সুব্যবহারের। সবাইকে হয়তো ভালোবাসা দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু কাউকে অবজ্ঞা না করাটাই বড় হুকুম।

একজন মানুষও যদি আমাদের আচরণে অপমানিত হয়, কষ্ট পায়, তাহলে সেই কষ্টের প্রতিফল পরকালে ভয়াবহ হতে পারে। রাসুল (সা.) বলেন:
“মুসলমান সেই, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।”
(সহীহ বুখারী)

একবার ভাবুন — আপনি মৃত্যুর পর মানুষ আপনাকে কী নামে স্মরণ করবে? “ভদ্র লোক”, না “ভয়ঙ্কর বস”?

জীবনের শেষে শুধু একফালি কাফনের কাপড় সাথী হবে। সেই সময় চাকরি, পদ, রাজনৈতিক পরিচয় কিছুই থাকবে না। কিন্তু আপনি কাকে কতটা ভালো ব্যবহার করেছেন, কার কাঁধে হাত রেখেছেন, কার পাশে দাঁড়িয়েছেন — সেই হিসাবটাই চিরন্তন হয়ে থাকবে। যারা ধর্মের কথা বলেন, তাদের থেকে মানুষ ধর্মীয় ব্যবহার—ই আগে আশা করে। শুধু টুপি, দাড়ি, দোয়া বা দলীয় সভায় উপস্থিত থাকলেই ইসলামিক হওয়া যায় না। ইসলামের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো আচরণ। যার ব্যবহার খারাপ, তার মুখে ইসলামের বুলি শোভা পায় না।

আজ দরকার introspection — আত্মসমালোচনার। মানুষ কাঁদছে আপনাকে ভয় পেয়ে — অথচ আপনি ভাবছেন, আপনি ‘ধর্মীয় নেতা’? দিন শেষে আপনি কী রেখে যাবেন — ভালোবাসা না অভিশাপ?

মন্তব্য করুন