
প্রকাশিত: ৩০ মার্চ, ২০২৪, ১১:৫৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
১৯৭১ সালে দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নর-নারী। তাদের মধ্যে একজন বগুড়ার সারিয়াকান্দির উপজেলার বাঁশহাটা এলাকার বাসিন্দা জহুরা বেগম। তিনি ১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়েছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার বয়স সংশোধন জটিলতায় বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) স্বীকৃতির কাজ। তদন্ত সাপেক্ষ বয়স প্রমাণের রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে পাঠালেও তা বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ করেন জহুরা। জন্মসাল ও নাম সংশোধনের জটিলতার কারণেই তাকে নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব হচ্ছে।
জহুরার বড় মেয়ে শিউলী উল্লেখ করেন, সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে মেয়ের চেয়ে মা (জহুরা) মাত্র এক বছরের বড়। জহুরা বেগমের স্থলে চায়না নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। তার মা বগুড়ায় ভোটার নিবন্ধনের ছবি তুলতে গেলে সেখানে ভাড়াটিয়াদের দেওয়া ভুল তথ্যে আর কম্পিউটার অপারেটরের গাফিলতিতে পরিচয়পত্রে ভূল তথ্য রয়েছে।
তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তবে সেসময় নির্যাতনের শিকার অনেক নারীর গল্প আরও বেশি বিভীষিকাময়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্যাতিত বীরাঙ্গনা (রণাঙ্গনের বীর নারী)। ইতিমধ্যে সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু সেই তালিকায় সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২নং ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের বাঁশহাটা এলাকার জহুরা বেগমের নাম ওঠেনি। নানা জটিলতায় হতাশায় ভুগলেও তিনি হৃদয়ের মাঝে রক্তক্ষরণ সয়েছেন নীরবেই।
একাত্তরে সেদিনের অমানবিক নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন জহুরা বেগম। অন্য ১০ জন নারীর মতোই স্বাভাবিকভাবে চলছিল সারিয়াকান্দির জহুরা-হাবিবুর দাম্পত্য জীবন। হঠাৎই পাক-হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার শিকার হয়ে সম্ভ্রমহারা জহুরার সংসারে নেমে আসে এক ভয়াবহ অন্ধকার। শুরু হয় প্রতিবেশী ও স্বজনদের ঘৃণা। দীর্ঘ তিনমাস বাপের বাড়িতে চিকিৎসা শেষে স্বামীর সংসারে ফিরে এসে স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন শুরু করলেও তাকে নিয়ে প্রতিবেশিরা উপহাস ও কটূক্তি করতেন। সমাজিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে গ্রাম ছেড়ে জেলা শহরে বিভিন্ন ছাত্রাবাসে (মেস) বুয়ার কাজ করেন।
জহুরা বেগম দাবি করেন, ভোটার তথ্য হালনাগাদের সময় তিনি জেলা শহরে ভাড়া বাসায় থেকে বুয়ার কাজ করতেন। ভোটার তথ্যে ভুল করে ‘জহুরা’ নামের পরিবর্তে ‘চায়না’ আর জন্মসাল ১৯৪৭ পরিবর্তে ১৯৬৯ লিপিবদ্ধ করে। পরবর্তীতে গ্রামে ফিরে এসে ভোটার স্থানান্তর, নাম ও জন্মসাল সংশোধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। ভোটার স্থানান্তর হলেও সংশোধন হয়নি নাম ও জন্মসাল। তিনি তথ্য সংশোধনের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
জানা গেছে, জহুরা বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর- ১৯২৮২৭১৪০০। নাম ও জন্মসাল সংশোধনের জন্য প্রায় দেড় বছর আগে উপজেলা নির্বাচন অফিসের নির্দেশনা মোতাবেক অনলাইনে আবেদন করেন।
পরবর্তীতে সংশোধন না হওয়ায় দুই দফায় (৬ মার্চ সর্বশেষ) নির্বাচন অফিসের আঞ্চলিক কার্যালয় রাজশাহীর গণ-শুনানিতে উপস্থিত হন। দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের বিষয়ে উপস্থাপন করেন। সংশোধন না হওয়ায় নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) স্বীকৃতি পাচ্ছেন না বলে আক্ষেপ করেন। মৃত্যুর আগে স্বীকৃতি পাবেন কিনা এ নিয়ে হতাশায় আছেন জহুরা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তৌহিদুর রহমান জানান, জহুরা বেগমের বীরাঙ্গনার স্বীকৃতির কাজ হাতে নিয়েছিলেন সাবেক ইউএনও মনিরুজ্জামান। সে সময় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর স্মারকের প্রেক্ষিতে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, জহুরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে পাকসেনাদের কাছে সম্ভ্রম হারানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মসাল ১৯৬৯ থাকায় তাকে বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হয়নি।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সোহাগ চৌধুরী জানান, জহুরা নামের ওই নারীর এনআইডি সংশোধন ‘গ’ ক্যাটাগরির হওয়ায় আবেদনটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে জমা আছে। তার সংশোধন আবেদনের প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য তদন্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া যায় মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন।
এদিকে সংশোধনের বিষয়টি প্রশাসনিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানার পর গত ৬মার্চ বগুড়া জেলার শুনানির দিন আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়েছিলেন জহুরা। তবে কাজ হয়নি বলে জেনেছেন।
মন্তব্য করুন