
প্রকাশিত: ৯ মে, ২০২৪, ০৮:১৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বরের ভোরে খুন হন বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক সোহেল চৌধুরী। সে সময় দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে। সেই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষিত হলো আজ বৃহস্পতিবার। আদালত নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন। খালাস পেয়েছেন ৬ জন।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে অবস্থিত ট্রাম্প ক্লাবের নিচে তার মরদেহ পওয়া যায়। এর আগে উপুড় হয়ে থাকা মরদেহ ঘিরে দাঁড়িয়েছিল শত শত মানুষ। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। রক্তের ছাপ শুরু হয়েছিল ক্লাবের সিঁড়ির সামনে থেকে। উপুড় হয়ে থাকা দেহটি যখন ঘোরানো হয় তখন পরিচিত মুখটি দেখে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। অনেকেরই চেনা এই মুখ। কারণ, তিনি ছিলেন সে সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক সোহেল চৌধুরী।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় এই অভিনেতার। বিয়ে করেছিলেন আরেক জনপ্রিয় তারকা পারভীন সুলতানা দিতিকে; যদিও পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী-সাক্ষী জবানবন্দিতে বলেছেন, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাইয়ের একটি ঘটনা থেকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, আজিজের আত্মীয় বান্টি ইসলাম, বান্টির বন্ধু আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে সোহেলের বিরোধের শুরু। এর জেরেই ট্রাম্প ক্লাবের সামনে ভাড়াটে লোক দিয়ে হত্যা করা হয় সোহেল চৌধুরীকে।
কিন্তু কী এমন ভয়ানক কারণ, যেজন্য খুন হতে হলো দেশের একজন জনপ্রিয় অভিনেতাকে। আবার তার বিচার কাজ শেষ করতে লেগে গেল প্রায় ২৬টি বছর!
দ্বন্দ্ব যেখান থেকে শুরু
বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের পশ্চিম পাশে ছিল একটি জামে মসজিদ। ওই ক্লাবে নাচ-গানসহ অসামাজিক কার্যকলাপ চলত। ক্লাবের অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে স্থানীয় মুসল্লিদের পক্ষে অবস্থান নেন সোহেল চৌধুরী। তিনি মসজিদ কমিটির লোকজন নিয়ে ক্লাব বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। এ নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝামেলা হয়। ট্রাম্প ক্লাবের কাজ ব্যাহত হলে সোহেল চৌধুরীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন আসামিরা।
২৪ জুলাই রাত। সোহেল চৌধুরী ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু সেই ক্লাবে যান। সেখানে বিতর্কিত ধনকুবের আজিজ মোহাম্মদ ভাইও ছিলেন। সেদিন রাতে বনানীর ট্রাম্প ক্লাবে গান বন্ধ করতে বলেছিলেন সোহেল চৌধুরী ও তাঁর বন্ধুরা। এ নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেলের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সোহেল চৌধুরী আজিজের ওপর ক্ষেপে যান। তখন সোহেলের বন্ধু কালা নাসির গুলি করতে যান আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে। এ সময় ক্লাবের শৌচাগারে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এই ট্রাম্প ক্লাবের মালিকানা ছিল বান্টি ইসলাম ও আশীষ চৌধুরীর।
সোহেলের বন্ধু গোলাম মোহাম্মদ বলেছিলেন, খুন হওয়ার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝগড়া হয়। বিষয়টি তাঁর সামনে ঘটেছিল। এ ছাড়া ট্রাম্প ক্লাবের বান্টি ইসলামের সঙ্গে সোহেলের দুই থেকে তিনবার ঝগড়া হয়। পরে তা মিটেও যায়। তবে আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি এড়ানো যায়নি। আশীষ চৌধুরীই সোহেল চৌধুরীকে ক্লাব থেকে বের করে দেন। ভবিষ্যতে সোহেলকে ক্লাবে না আসার জন্য হুমকিও দেন।
হত্যার আগে দেওয়া হয় হুমকি
সোহেল চৌধুরী হত্যা নিয়ে তাঁর মা নূরজাহান বেগম আদালতকে বলেন, সোহেল খুন হওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে টেলিফোনে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের লোকজন হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, সোহেলের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে।
হত্যা করা হয় যেভাবে
সোহেল চৌধুরীকে হত্যার বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বরে সোহেল চৌধুরী ক্লাবে ঢুকতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁকে ক্লাবে ঢোকার অনুমতি না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে রাত তিনটার দিকে সোহেল চৌধুরী আবার ক্লাবের সামনে আসেন। তখন পেশাদার খুনিদের দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মামলার সাক্ষী আবুল কালাম পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, সেদিন সোহেলসহ সাত থেকে আটজন লোক ক্লাবের সামনে গেলে হঠাৎ গুলি করা হয়। সোহেল চৌধুরীর পেটে গুলি লাগে। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। সন্ত্রাসীদের গুলিতে সেদিন গুলিবিদ্ধ হন নীরব ও দাইয়ান নামে আরও দুইজন।
চার্জশিটে যা বলা হয়েছিল
১৯৯৯ সালে গোয়েন্দা পুলিশ এই মামলার চার্জশিট দেয়। মামলাটি তখন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। চার্জশিটে বলা হয়েছিল, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই ট্রাম্প ক্লাবে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর বিভিন্ন ইস্যুতে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়।
এজন্য আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলাম সোহেল চৌধুরীকে ‘শিক্ষা দিতে’ চান। ২৪ জুলাই ছাড়াও কয়েকবারই সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে ট্রাম্পস ক্লাবের অতিথি এবং কর্মীদের গোলমাল হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে। ক্লাবটিতে অসামাজিক কার্যকলাপ, নাচ গান, মদ্যপান করা হত বলে চার্জশিটে উল্লেখ আছে। চার্জশিটে বলা হয়, মোট ৯ জন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাদিয়া আফরিন শিল্পী জানিয়েছেন, চার্জশিটের পর ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এই মামলার।
মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করতে নথি গায়েব
মামলায় অভিযোগ গঠন হবার পর বিচারের জন্য মামলাটি পাঠানো হয় ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। তখন মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একজন আসামি ২০০৩ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৪ সালে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুলসহ আদেশ দেন।
কিন্তু ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট আদালত রুলটি খারিজ করে হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার আদেশ দেন। এর ফলে মামলার বিচার কাজ চালাতে আইনি বাধা দূর হয়। কিন্তু সেই আদেশ আর নিম্ন আদালতে পৌঁছায়নি। ২০২২ সালের শুরুতে নতুন করে গায়েব নথি উদ্ধারে একটি রিট করা হয়, আর তারপরই নতুন করে শুরু হয় মামলার কার্যক্রম। তারই চূড়ান্ত পরিণতিতে অবশেষে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির রায় ঘোষিত হলো।
মন্তব্য করুন