সিলেট ব্যুরো

প্রকাশিত: ৫ জুলাই, ২০২৪, ০৮:০৪ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

আতঙ্ক কুশিয়ারা তীরে

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ভিটেবাড়িতে বন্যার পানি উঠেছে অনেক আগেই। এখন শোবার ঘরে বৃষ্টির পানি থৈথৈ করছে। কোথাও খাট ছুঁইছুঁই। কখন জানি খাটটাও ডুবে যায়, সেই ভয়ে সারাক্ষণ থাকতে হয় তটস্ত। রান্না ঘরে চুলো জ্বলছে না অনেক দিন। শুকনো খাবার খেয়ে কোনো রকমে পার করতে
হচ্ছে দিন। আর গবাদী পশু? হাঁটুপানি, কোথাও সারা শরীর পানির নিচে ডুবে আছে। সাথে আছে সাপ-বিচ্ছুর আতঙ্ক। এমন দৃশ্য এখন সিলেটের কুশিয়ারা পাড়ে প্রায় সবার ঘরে। দিন কাটছে আতঙ্কে।

সিলেটে অন্তত ৫ উপজেলায় মানুষ নির্ঘুম দিন-রাত কাটাচ্ছেন। পালা করে জেগে থাকছেন অনেকে। বৃষ্টি হলেই ভয়ে তাদের ভেতর আঁৎকে উঠে। যদি আরও পানি বেড়ে যায়! তাহলে ভোগান্তি-দুর্ভোগের পাল্লা ভারি হবে আরও।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এখনো বিপৎসীমার উপরে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ৬ পয়েন্টের পানি। চলমান বন্যায় এ জেলায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬ লক্ষাধিক। বিশেষ করে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী উপজেলা বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও
বালাগঞ্জের অবস্থা এখন খুব সুচনীয়। কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ (ডাইক) ভেঙে পানি প্রবেশ করছে এসব উপজেলায়। বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করার ফলে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকায়। গত দুই দিন ধরে সিলেটে বৃষ্টিপাত কম হওয়াতে অনেক এলাকা থেকে পানি কিছুটা
নেমে গেছে। কিন্তু কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ভাঙছে বাঁধ। দীর্ঘ হচ্ছে বন্যা। বাড়ছে আতঙ্ক।

জকিগঞ্জ উপজেলার অন্তত ৫ স্থানে কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ (ডাইক) ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ৭৩ গ্রাম। তলিয়ে গেছে কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্রও। সিলেট-বিয়ানীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কসহ বিয়ানীবাজার-চন্দরপুর বৃষ্টির পানি আর ঢলে কুশিয়ারা নদীর ডাইক অতিক্রম করে পানি ডুকছে লোকালয়ে। কুশিয়ারা নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে বালাগঞ্জ উপজেলার ৬ ইউনিয়ন। বন্যাক্রান্ত মানুষের জন্য খোলা হয়েছে ৪৯টি আশ্রয় কেন্দ্র। বালাগঞ্জের প্রধান সড়কে হাটুর উপরে পানি। উপজেলা পরিষদ, বালাগঞ্জ থানায় ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নদীর পানি প্রবেশ করেছে।

গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন ও এলজিইডি সড়ক ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একইভাবে ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাজার হাটসহ নিচু এলাকাগুলোতে ইতোমধ্যেই বসতঘরে পানি ঢুকে গেছে। অনেকে পানিবন্দি অবস্থায় বাড়িতেই অবস্থান করছেন।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার ১৩ উপজেলায় ৯৬টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত। ১ হাজার ১৬০টি গ্রামের ৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৩ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। জেলার ৬৪৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ২৩৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
অপরদিকে সুরমার পানিতে দেড়শ এবং পাহাড়ি ঢলে তিনটি উপজেলার ২২৫ গ্রাম পাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি প্রথমেই আঘাত হানে। এ যাবত পাহাড়ি ঢলে এ তিন উপজেলার
২২৫ গ্রাম পাবিত হয়ে আক্রান্ত হন ১ লাখ ৬২ হাজার ২৩৪ জন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার মোট এক হাজার ৪৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৯৮টিতে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট সদর উপজেলায় ৩৭, বিশ্বনাথে ২, বালাগঞ্জে ৫৫ ফেঞ্চুগঞ্জে ৩২, গোলাপগঞ্জে ২৭, বিয়ানীবাজারে ৫৪, জকিগঞ্জে ২৩, কানাইঘাটে
৪, জৈন্তাপুরে ৩, গোয়াইনঘাটে ২, কোম্পানীগঞ্জে ৬৫, দক্ষিণ সুরমায় ২২ ও ওসমানীনগরে ৭২টি বিদ্যালয় রয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাখাওয়াত এরশেদ বলেন, ৩৯৮ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আর বাকিগুলো পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাইদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘বন্যার কারণে জেলায় ৭৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যালয় রয়েছে ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়। কুশিয়ারা অববাহিকার এসব এলাকায় বন্যার পানি কমছেই না।’

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পাঠদান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। পানি কমলে বাড়তি ক্লাসের মাধ্যমে এই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।’

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস জানান, গত কয়েকদিন ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টি হয়নি। সিলেটের নদীগুলো পানিতে পরিপূর্ণ থাকায় উজানের পানি ধীর গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। চলমান বন্যায় সিলেটের ২৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মেরামতে ১৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে বন্যার পানি পুরোপুরি না নামলে এসব বাঁধের কাজ করা যাবে না।

বালাগঞ্জ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মারিয়া হক বলেন, বালাগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি সময়ে সময়ে ভয়াবহরূপ ধারণ করছে।

উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণও প্লাবিত। উপজেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান গুলো খুলে দেয়া হয়েছে আশ্রয়ণের জন্য। এ পর্যন্ত চলমান বন্যায় প্রায় ১৩১ মেট্রিকটন চাল বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানবৃন্দকে দেওয়া হয়েছে। নগদ অর্থ, শুকনো খাবার ৯৫০ প্যাকেটসহ শিশু খাদ্য, গুখাদ্য দেওয়া হয়েছে ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বন্যার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত। জেলা প্রশাসককে আমাদের অবস্থান সময়ে সময়ে অবগত করেছি।

জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসনিম জানান, প্রথম দফায় বন্যার পানিতে উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভাঙে এখন সেগুলোর ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে উপজেলায় ৭টি ইউনিয়নের ৭৩টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বেশ কিছু পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। যেসব আশ্রয় কেন্দ্রে পানি উঠেছে সেগুলো থেকে মানুষকে সরিয়ে নেয়ার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করছি।

মন্তব্য করুন