
প্রকাশিত: ১৩ জুলাই, ২০২৪, ০৯:০৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের শুরু থেকে সরকারি কর্মচারীদের ৫ বছর অন্তর প্রদর্শিত সম্পত্তির হিসাব জমা দেওয়ার দাবি উঠেছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সায়ও ছিল এতে। নতুন সরকারের প্রায় ৬ মাস অতিবাহিত হলেও একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তার সম্পদের হিসাব জমা দেননি। এ বিষয়ে পাননি সরকারের কঠোর কোনো নির্দেশনাও। হিসাব জমা দেওয়ার বিধি কার্যকর না হওয়ায় উৎসাহিত হয়েছেন এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, যারা চাকরিতে যোগদান করেই দুর্নীতির শ্রোতে গা ভাসিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন অবৈধ অর্থ। মালিক হচ্ছেন পর্বত সমান সম্পদের।
প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার যে বিধান সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিতে বলা আছে, তা এক প্রকার অকার্যকর হয়ে গেছে। গত এক বছরে মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে নতুন সরকারের ৬ মাসে সরকারি কোনো কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা সচিবরাও হিসাব জমা দেননি। তাদের দেখাদেখি অন্যরাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অন্তত ১০টি মন্ত্রণালয়-বিভাগে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বিষয়টিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা যেমন অমান্য করা হচ্ছে, তেমনি আচরণবিধিকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে বলে মনে করেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব, জনপ্রশাসনে দুই-তিনজন উপ-সচিব ও যুগ্ম সচিব, তিন-চারজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং দু-তিনজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ৪-৫ জন কর্মচারী তাদের হিসাব বিবরণী জমা দিয়েছেন। অন্যান্য মন্ত্রণালয়-বিভাগেরও দু-একজনের বেশি কেউই হিসাব দেননি বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রশাসন শাখা থেকে জানা গেছে।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি ১৩-তে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী প্রতি ৫ বছর অন্তর প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করবেন। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার, সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি এবং ৫০ হাজার টাকা বা ততধিক মূল্যের অলঙ্কারাদিসহ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দেবেন। কিন্তু এমন বিধান মানছেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগে প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করাকেই অজুহাত দেখাচ্ছেন সরকারি চাকুরেরা। তাদের ভাষ্য, আয়কর রিটার্ন দাখিলের পর আলাদা করে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবে তাদের এ যুক্তি সঠিক নয় বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘কর্মচারীরা সম্পদের হিসাব দেন না। ফলে চাকরিতে যোগদানের পর তাদের সম্পদ বাড়ল কি কমল, তা জানা যায় না। অবশ্যই প্রতি ৫ বছর পর পর সম্পদের হিসাব দেওয়ার যে বিধান আছে, সেটি আরও যুগোপযোগী করে সম্পদের হিসাব নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কর্মচারীদের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সম্পদের হিসাবও নিতে হবে। তা হলে স্বচ্ছতা আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা সময়ের দাবি। এমন পদ্ধতি চালু করতে হবে যেন কেউ হিসাব না দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই কর্মচারীকে চিহ্নিত করা যায়। এতে সবাই হিসাব দিতে বাধ্য থাকবে। এ ছাড়া সম্পদের হিসাব না দিলে কী শাস্তি হবে, তা-ও নির্দিষ্ট করতে হবে।’
বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব (চলতি দায়িত্ব) মো. মাসুদুল হাসান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়ে আমরা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই একটা মিটিং করব। আপনি মিটিংয়ের পর আমার কাছ থেকে ফলোআপ পাবেন।’ কেন হিসাব জমা দেয়নি সেটা মিটিংয়ে উঠে আসবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মেয়াদে সরকার গঠনের ১০ দিনের মাথায় ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় দুর্নীতি বন্ধে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টিও ছিল। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধেও অভিযান অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি পুরো বাস্তবায়ন করা হবে।
মন্তব্য করুন