
প্রকাশিত: ২৯ জুলাই, ২০২৪, ০৭:২৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বর্তমানে দুটো শব্দ প্রচুর শোনা যায়। তা হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং ‘এল নিনো’। বিষয়টি আসলে কী? কি বলছে জাতিসংঘ? কোনো একটি জায়গায় বহু বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়-পড়তা ধরন, তাকেই বলা হয় জলবায়ু। আবহাওয়ার সেই চেনাজানা ধরন বদলে যাওয়াকেই বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন।
পৃথিবী গরম হয়ে পড়ছে। ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়ার বহুদিনের চেনাজানা আচরণ। আর এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘এল নিনো’। এই জলবায়ু সংকটের সমস্যাগুলো আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এল নিনো (El Nino) আর লা নিনা (La Nina) এই দুটি হলো স্প্যানিশ শব্দ। এল নিনো হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি জলবায়ুর ধরন, যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য, সুপেয় পানি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁঁকি বৃদ্ধি পাবে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা।
টানা তিন বছর ‘লা নিনা’র দাপটের পর এল নিনোর আবির্ভাবের কথা নিশ্চিত করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত এল নিনোর এই চক্র স্থানীয়ভাবে খরা ও ক্ষুধার পাশাপাশি প্রাণিবাহিত রোগ বাড়াতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। আবার গত কয়েক বছর ধরেই খরা, অতিবৃষ্টি আর তীব্র শীতে পৃথিবীবাসী নাকাল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে বন্যা, দাবানল আর ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিশেষজ্ঞদের মতামত-বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি এল নিনো ও লা নিনার প্রভাবেই এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।
আর এরমধ্যে বিশ্বব্যাপী রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণতম দিন হিসেবে চিহ্নিত হলো গত সোমবার। মাত্র এক দিন আগে সেট করা আগের রেকর্ডটিকে ছাড়িয়ে গেছে। ইউরোপীয় কোপার্নিকাস নেটওয়ার্ক অনুসারে জুলাই ২১, ২২ এবং ২৩ এই প্যাটার্নটি অব্যাহত ছিল।
২২ জুলাই তাপমাত্রা ১৭.১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৬২.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) শীর্ষে ছিল। এই দিনগুলো কেবল ২০২৩-এর জন্য একটি নতুন রেকর্ড তৈরি করেনি বরং বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্রমবর্ধমান তীব্রতা সম্পর্কে উদ্বেগও উত্থাপন করেছে, ২০২৪ সম্ভাব্যভাবে এই তাপমাত্রাকে অতিক্রম করবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এ বিষয়ে কঠোর সতর্কতা জারি করেছেন। তার বক্তব্য অনুসারে বিশ্ব একটি ‘চরম তাপ মহামারি’র সাথে লড়াই করছে। এই উদ্বেগজনক ঘোষণাটি রেকর্ড-ব্রেকিং তাপমাত্রার একটি সিরিজ অনুসরণ করে। যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তীব্রতর তাপ তরঙ্গগুলোকে মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনের ওপর জোর দিয়েছে।
তাপের রেকর্ড নজিরবিহীন
গুতেরেস পরিস্থিতির মাধ্যাকর্ষণকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সাথে ক্রমবর্ধমান মারাত্মক তাপ তরঙ্গের অধীনে বিলিয়ন কোটি মানুষ চরম তাপ মহামারির মুখোমুখি হচ্ছে। ’এটি একটি বিস্ময়কর ১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইটে রূপ নেয়।
তাপ তরঙ্গ: এক নীরব ঘাতক
ঘূর্ণিঝড় বা বন্যা বড় বিপর্যয়। এর মতো আরও দৃশ্যমান বিপর্যয়মূলক ঘটনাগুলোর বিপরীতে, তীব্র তাপ তরঙ্গগুলো প্রায়ই কম লক্ষ্যণীয়। তবে অনেক বেশি মারাত্মক।
জাতিসংঘের ‘কল টু অ্যাকশন অন এক্সট্রিম হিট’ নথি প্রকাশ করেছে। চরম তাপ ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ৪৮৯,০০০ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
সম্পূর্ণ বিপরীতে, ঘূর্ণিঝড় একই সময়ের মধ্যে প্রতি বছর ১৬,০০০ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
অসুস্থসহ দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি সৃষ্টি করে এই ‘নীরব ঘাতক’। বিশেষ করে দরিদ্র, বয়স্ক যুবকের ক্ষেত্রে।
জাতিসংঘ মহাসচিব এই চরম তাপের অসম প্রভাবের ওপর জোর দিয়েছেন। উল্লেখ করেছেন, ‘পঙ্গুত্বপূর্ণ তাপ সর্বত্র রয়েছে। তবে এটি সবাইকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না।’ মহাসচিব সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, চরম তাপ বৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাও বাড়িয়ে দেয়। মানুষকে আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়। এই সংকটের প্রতিক্রিয়ায়, বিশ্বব্যাপী দেশগুলোকে চরম তাপের প্রভাব প্রশমিত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন গুতেরেস। মূল সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে আরও ভালো তাপ-তরঙ্গ সতর্কীকরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন। এছাড়া প্যাসিভ শীতল সমাধানের প্রচার, শহুরে নকশার উন্নতি, বহিরঙ্গন কর্মীদের সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলোকে সমাধান করা।
জাতিসংঘ অনুমান করে এই ব্যবস্থাগুলো ব্যাপকভাবে গৃহীত হোক। তারা ২০৫০ সালের মধ্যে ৩.৫ বিলিয়ন মানুষকে রক্ষা করতে পারে। পাশাপাশি কার্বন নির্গমন হ্রাস এবং গ্রাহকদের বার্ষিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। অধিকন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুসারে, ৫৭টি দেশে তাপ স্বাস্থ্য সতর্কতা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করে প্রতি বছর আনুমানিক ৯৮,৩১৪ জনের জীবন বাঁচাতে পারে।
যেহেতু বিশ্ব একটি দ্রুত উষ্ণায়ন গ্রহের বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর থেকে পদক্ষেপের আহ্বান স্পষ্ট: জীবন রক্ষা করতে এবং চরম তাপের বিধ্বংসী প্রভাবগুলো প্রশমিত করার জন্য অবিলম্বে এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বর্তমান তাপের রেকর্ডগুলো জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা এবং তাপ তরঙ্গের ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে দুর্বল জনসংখ্যাকে রক্ষা করার জন্য কার্যকর কৌশল বাস্তবায়নের জরুরি অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর। ২০২৪ সালের এখনো কয়েক মাস বাকি। তাই চলতি বছর আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে যেতে পারে। তাপপ্রবাহের কারণে ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪ লাখ ৮৯ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যেখানে প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়ে মারা গেছে ১৬ হাজার মানুষ।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বের ৭০ শতাংশ শ্রমিক তীব্র তাপমাত্রার মধ্যে কাজ করার ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন, যা ২০০০ সালের চেয়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। আর তীব্র গরমের কারণে ২০২৩ সাল নাগাদ বিশ্বে অর্থনৈতিক ক্ষতি ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি কী?
মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য এই পরিবর্তনের অর্থ কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে বদলে যাবে আমাদের জীবনযাপন। পানির সংকট তৈরি হবে। খাদ্য উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে। কোনো কোনো অঞ্চল বিপজ্জনক মাত্রায় গরম হয়ে পড়বে এবং সেই সাথে সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা প্লাবিত হবে। ফলে সেসব জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে। গরিব দেশগুলোতে এসব বিপদ মোকাবিলার সক্ষমতা কম বলে তাদের ওপর এই চরম আবহাওয়ার ধাক্কা পড়বে সবচেয়ে বেশি। তাপমাত্রা বাড়ায় উত্তর মেরুর জমাট বাঁধা বরফ এবং হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলে সাগরের উচ্চতা বেড়ে উপকুলের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
এছাড়া সাইবেরিয়ার মতো অঞ্চলে মাটিতে জমে থাকা বরফ গলতে থাকায় বরফের নিচে আটকে থাকা মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে।
ফলে, মিথেনের মতো আরেকটি গ্রিনহাউস গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। পৃথিবীর উষ্ণতা তাতে আরও বাড়বে। বন-জঙ্গলে আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়বে। চির চেনা বসতির আবহাওয়া বদলের জেরে অনেক প্রাণী নতুন জায়গায় চলে যাবে বা যাওয়ার চেষ্টা করবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শিল্প বিপ্লব শুরুর আগে বিশ্বের যে তাপমাত্রা ছিল তার থেকে বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা গেলে বড় ধরনের বিপদ এড়ানো যাবে। তা না পারলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন।
লেখক: সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন