প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বার, ২০২৪, ১১:২৫ এ এম

অনলাইন সংস্করণ

দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে বাল্য বিয়ে ও দারিদ্রতার কারনে ৭ বছরে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী কমেছে

 

দেশবাংলা রিপোর্টঃ

দেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে গত সাত বছরে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী কমেছে। পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে ২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল ২৮ লাখ ২ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থী। 

স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারলে তাদেরই চলতি বছরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। তবে এবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। 

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সাত বছরের শ্রেণি কার্যক্রমে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষার স্বাভাবিক পথ থেকে ছিটকে পড়েছে। গড়ে প্রতি বছর ২ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

গত বছর মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ। যা চার বছর আগে ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, স্কুল-কলেজ পার হওয়ার আগেই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার দুটি বড় কারণ হলো—বাল্যবিবাহ এবং পরিবারের দারিদ্র্যতা। শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে সরকারকে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান শিক্ষাবিদদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর ফলাফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, গত বছরের ১ জুলাই দেশে ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৬ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ছিল। 

এর মধ্যে ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশ শিক্ষায় রয়েছে, অর্থাৎ তারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। বাকি ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ বা  ২ কোটি ৬২ লাখ শিশু ও তরুণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৪০ দশমিক ৯১। 

মহামারির ঠিক আগে ২০১৯ সালে দেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে না থাকা জনগোষ্ঠীর হার ছিল ২৯ দশমিক ২৭। সেই হিসাবে শিক্ষার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর হার গত পাঁচ বছরে প্রায় ১১ শতাংশ বেড়েছে।

 গত ৯ মে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত ‘বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশু-কিশোরদের শিক্ষার চ্যালেঞ্জ :সমাধান কোন পথে’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

 অনুষ্ঠানে মূল উপস্থাপনায় গণসাক্ষরতা অভিযানের কার্যক্রম ব্যবস্থাপক মো. আবদুর রউফ আলোচনাপত্র উপস্থাপন করেন। তিনি ঝরে পড়া রোধে প্রকল্পের পরিবর্তে কর্মসূচিভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া, ‘মিড ডে মিল’ সর্বজনীন করা, উপবৃত্তির টাকা বাড়িয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ৫০০ টাকা করা, বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোসহ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন।

এদিকে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারলে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে ঝরে পড়ার হারটি কম থাকে। তবে চার বছরের ব্যবধানে উচ্চমাধ্যমিকে এই হার বেড়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার এখন ২১ শতাংশের বেশি, যা চার বছর আগে ছিল প্রায় ১৮ শতাংশ। 

জানা গেছে, ২০১৫ সালে প্রাথমিক শেষ করা সাড়ে ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ লাখ ৯৯ হাজার ১৬৯ জন অষ্টম শ্রেণি শেষ করে ২০১৮ সালে জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে পাশ করে ২২ লাখ ৩০ হাজার ৮২৯ জন। অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি শেষ করে ২০২২ সালে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৩ শিক্ষার্থী।

 ২০২৪ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এসএসসি) বসার কথা ছিল তাদের। কিন্তু চলতি বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসে ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ মাধ্যমিক পর্যায়ে গত ২ বছরে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর ২৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। 

দুই বছরে বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ‘উদ্বেগজনক’ বলছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের মতে, প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ নিশ্চিত করা গেলেও মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। 

এ জায়গায় সরকারকে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। যদিও শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা ও ধরে রাখার জন্য সরকার প্রতি বছর উপবৃত্তি, বিনা মূল্যে বই, খাবার দেওয়াসহ অন্যান্য খাতে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। এরপরও বিভিন্ন পর্যায়ে এত অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী কেন ঝরে পড়ছে—এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা এখান থেকে কওমি মাদ্রাসায় চলে যাচ্ছে।

 এ সময় তিনি মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ধরে রাখার তাগিদ দেন। মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তিতে আবেদনের লটারির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। 

বিষয়টি নিয়ে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিবের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন জানিয়ে সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, ‘আমি বলছি না, মাদ্রাসায় পড়াশোনা ভালো না। শিক্ষার মান খারাপ, তা নয়। 

কিন্তু এ শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। মানে তারা সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিল। তাহলে একটু বড় হয়েই তারা সাধারণ শিক্ষায় না থেকে মাদ্রাসায় চলে যাচ্ছে কেন? সেই কারণটা খোঁজা জরুরি।’ 

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, যারা সাধারণ শিক্ষা দিয়ে অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষাজীবন প্রবেশ করছে, তারা যেন এখান (স্কুল-কলেজ) থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেন, সেদিকে নজর দিতে হবে। কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।’

পড়ালেখা বাদ দিয়ে ধরতে হচ্ছে পরিবারের হাল :পরিবারে আর্থিক সংকট, তাই অষ্টম শ্রেণির পরই লেখাপড়ায় ইতি টানেন সাভারের মো. রবিউল ইসলাম। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। তিন ভাইবোন আর মাকে নিয়ে তার বেড়ে ওঠা। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মা পড়াশোনার খরচ চালান। 

বয়সের কারণে তিনি (মা) অসুস্থ হওয়ার পর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠা পর্যন্ত টিউশনি করে নিজের খরচ চালিয়েছে রবিউল। কিন্তু পরিবারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাওয়ায় পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের বয়ড়া বাজার এলাকার আবুল কালাম ও শেফালী আক্তার দম্পতির বড় ছেলে বাঁধন। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে, তারপর আর স্কুলে যায়নি।

 পেটের তাড়নায় অটোরিকশা নিয়ে ছুটে বেড়ান সড়কের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। দারিদ্র্যের গোলক ধাঁধায় পথ হারিয়ে ইট ভাঙার মতো কায়িক পরিশ্রমের কাজে বাধ্য হয়েছেন আব্দুর রহমান। 

মাত্র ১৬ বছর বয়সে যখন তার হাতে থাকার কথা ক্লাসের বই, ঘুরে বেড়ানোর কথা বন্ধুদের সঙ্গে, মেতে ওঠার কথা খেলার মাঠে—সেই বয়সেই তাকে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে পরিবারের দায়িত্ব।

মন্তব্য করুন