
প্রকাশিত: ৩১ মে, ২০২৪, ১১:২৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মালয়েশিয়াপ্রবাসী কর্মীদের কথা বিবেচনা করে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
এই বিশেষ ফ্লাইটে ২৭১ জন কর্মী মালয়েশিয়া গেলেও বাকি থাকবে বাংলাদেশের অনুমোদনকৃত আরও ৩১ হাজার ৪০৩ জন মালয়েশিয়াপ্রবাসী কর্মী।
নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় এসব কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হলো। কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সময় শেষ সময় ছিল গতকাল শুক্রবার। মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকালই দেশটিতে যাওয়ার শেষ সুযোগ ছিল কর্মীদের। আজ শনিবার থেকে আর কেউ কর্মীভিসায় মালয়েশিয়া যেতে পারবেন না।
এদিকে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য গতকাল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনেক কর্মীকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এসব কর্মীদের অনেকেই এজেন্সি থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ লাখ টাকায় টিকিট কিনেছিল। কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এজেন্সিগুলো তাদের বলছে যে, দুই দেশের সরকার যাওয়ার সময় আরো এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন বাড়াবে। তবে ভিটে মাটি বিক্রি করে যাওয়ার জন্য সবকিছু করলেও শেষ পর্যন্ত তারা যেতে পারবে কিনা এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন আটকে পড়া কর্মীদের সঙ্গে থাকা স্বজনরা।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত ২১ মে পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। গত ২১ মের পর আর অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, এ সময়ে মন্ত্রণালয় আরো ১ হাজার ১১২ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দিয়েছে।
অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বাংলাদেশ বিমানসহ অন্যান্য এয়ারলাইন্সের নিয়মিত ফাøইটে মাত্র ১ হাজার ৫০০ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন। এর সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে ২৭১ জন কর্মী গেলে সংখ্যাটি দাঁড়াবে ১ হাজার ৭৭১ জনে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অনুমোদনকৃত মালয়েশিয়াপ্রবাসী ৩১ হাজার ৪০৩ জন কর্মীর দেশটিতে যেতে পারছেন না।
আটকে থাকা কর্মীদের বিষয়ে বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের সভাপতি আবুল বাশার বলেন, আমরা এ বিষয়ে একাধিকবার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমরা দু-এক মাস সময় বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলাম। তাহলে সব কর্মীকে পাঠানো যেত। কারণ কর্মীরা যেতে না পারলে তাদের আর্থিক ক্ষতি হবে।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈকত চন্দ্র হালদার বলেন, আপাতত সময় বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। শুক্রবার (গতকাল) কর্মীরা পৌঁছানোর পর যারা বাকি থাকবেন তাদেরকে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, আরও ১৪টি দেশ একই সমস্যায় পড়েছে। আমরা আমাদের সিংহভাগ কর্মীদের পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। সময় বাড়ানোর সুযোগ না থাকলেও আমরা এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যা ৭ টা ১৫ মিনিটে বিশেষ ফ্লাইট ছাড়ার তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. আল মাসুদ খান বলেন, এই ফ্লাইটে মোট ২৭১ জন যাত্রী পরিবহন করা হবে।
তিনি জানান, ফ্লাইটের যাত্রীদের নামের তালিকা, পাসপোর্ট নম্বরসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বিমানের মতিঝিল বিক্রয় অফিসে প্রদান করবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা)। তালিকা অনুযায়ী নগদ টাকায় ফ্লাইটের টিকিট ক্রয় করতে পারবেন প্রবাসীরা। বিশেষ অতিরিক্ত ফ্লাইটের ভাড়া জনপ্রতি ৭৩ হাজার ৬১৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
হাজারো কর্মীর ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে তিন-চারদিন ধরেই বিমানবন্দরে অবস্থান করছেন। অধিকাংশের অভিযোগ, ট্রাভেল এজেন্টদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দেওয়ার পরও তারা টিকেট পাচ্ছেন না। এজেন্টরা শুধু আজ-কাল বলে শেষমূহূর্তে এনে দাঁড় করিয়েছে।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাসিন্দা মো. সাইফুল্লাহর গতকাল মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু টিকেটের ব্যবস্থা না হওয়ায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টার্মিনাল-১ সামনে হতাশা নিয়ে বসে থাকেন।
তিনি বলেন, আমার ভিসা, পাসপোর্টসহ ওয়ার্ক পারমিট আছে। কিন্তু টিকেট নেই।
মালয়েশিয়া যেতে না পারলে আত্মহত্যা করব। তবুও বিমানবন্দর ছাড়ব না। তার মতো ২৪ জন মালয়েশিয়াগামী কর্মী বিমানবন্দরে বসে আছেন। নাটোরের ইলিয়াস হোসেনও গতকাল মালয়েশিয়া যেতে না পেরে আক্ষেপ করেন।
এদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধের সময় ঘনিয়ে আসায় বাড়তি দামে টিকিট বিক্রির অভিযোগ করেছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এ বিষয়ে গত রবিবার বিমানের টিকিট বাণিজ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ করেন একটি ট্রাভেল কোম্পানির কর্মকর্তা।
অভিযোগে বলা হয়, মালয়েশিয়া যেতে বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে সরাসরি টিকিট করতে পারছে না এজেন্সিগুলো। গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে (জিডিএস) ফ্লাইটের টিকিট দেখাচ্ছে না। এই সুযোগে বিমানের কর্মকর্তারা দুর্নীতি করছেন। এতে টিকিটের দাম এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
অন্যদিকে শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার শেষ মূহূর্তে বাংলাদেশের মত অন্যান্য দেশের কর্মীরাও ভিড় করেছেন মালয়েশিয়া। এর ফলে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে বিভিন্ন দেশের কর্মীদের উপচে পড়া ভিড় তৈরি হয়েছে।
কুয়ালালামপুরের দুটি আন্তর্জাতিক বিমান টার্মিনালের ফ্লোরে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৪টি দেশ থেকে আসা প্রায় ২০ হাজার কর্মী অবস্থান করছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার কর্মী বাংলাদেশের।
শেষ মুহূর্তে উপচে পড়া কর্মীর ভিড়ে কর্মী ও নিয়োগকর্তা উভয়েরই দুর্ভোগ বেড়েছে। নিজেদের কর্মী শনাক্তে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নিয়োগকর্তাদের। এদিকে কর্মীরা বলছেন, তাঁরা তিন-চার দিন ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করছেন। কেউ নিয়োগকর্তার খোঁজ পাচ্ছেন, আবার কেউ পাচ্ছেন না। নিয়োগ কর্তারা তাঁদের শুধু অপেক্ষা করতে বলছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবিতে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালে শ্রমিকদের শুয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। বিমানবন্দরের এমন দৃশ্য ভাইরাল হওয়ার পর এ নিয়ে কথা বলেছেন দেশটির অভিবাসন বিভাগের পরিচালক জেনারেল দাতুন রুসলিন জসুহ।
তিনি বলেন, ৩১ মের পর থেকে মালয়েশিয়ায় আর বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না। ফলে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ সময়ে বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে নিয়োগ দিয়েছে। সেসব শ্রমিক আসার কারণে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
জেনারেল দাতুন বলেন, মালয়েশিয়ায় সাধারণত প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১ হাজার বিদেশি শ্রমিক আসেন। তবে গত ২২ মে থেকে এ সংখ্যা বেড়ে ২ হাজার ৫০০ জনে পৌঁছেছে। এরপর ২৭ মে থেকে তা বেড়ে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
তিনি জানান, শ্রমিকরা যেনো ভোগান্তিতে না পড়েন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত খাবার আর পানীয়ের ব্যবস্থা করা হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিয়োগকারীদের সহযোগিতা চান তিনি।
প্রবাসী কর্মীদের এই বিশাল চাপ সামলাতে মালয়েশিয়া সরকারের অভিবাসন বিভাগ থেকে নিয়োগকর্তাদের জন্য কর্মী খোঁজার সময়সূচি নির্ধারণ করে দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত কাউন্টার খোলা হয়েছে। অভিবাসন কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বিদেশি কর্মীদের জন্য পানি ও খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগপ্রক্রিয়ার দুর্নীতি নিয়ে গত ২৮ মার্চ মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দেয় জাতিসংঘের চারজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ। তবে দুই দেশের সরকারই এই চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
গত রবিবার জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) এই চিঠি প্রকাশ করেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টোমোয়া ওবোকাটা, রবার্ট ম্যাককরকোডালে, গেহাদ মাদি ও সিওবান মুল্লালি এই চিঠি দেন।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশি কর্মীদের জনপ্রতি সাড়ে ৪ থেকে ৬ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়োগ ফি দিতে হচ্ছে, যা ২০২১ সালে এই দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) খেলাপ। ওই এমওইউ অনুযায়ী, এই ফি হবে ৭২০ ডলার পর্যন্ত। বাংলাদেশি প্রবাসীরা বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ নিয়োগ ফি প্রদান করে থাকেন, যা বাজারের প্রচলিত হারের চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় একটি অপরাধী নেটওয়ার্ক কাজ করে। তারা কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করে এবং ভুয়া কম্পানিতে নিয়োগ দেয়। এই নিয়োগের সঙ্গে জড়িত নিয়োগকর্তা, এজেন্ট ও সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন। গত বছর সেখানে গেছেন ৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৩ জন কর্মী। এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গেছেন ৪৪ হাজার ৭২৭ জন।
মন্তব্য করুন