
প্রকাশিত: ১৬ মে, ২০২৪, ০৯:৪৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
দিনের পর দিন অপর্যাপ্ত ঘুম হলে বয়ঃসন্ধিতে ‘সাইকোটিক ডিজঅর্ডার’এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্তত সাম্প্রতিক গবেষণা তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শিশুদের ঘুমের সমস্যা তখনই তাদের মা-বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে যখন শিশুরা আশানুরূপ পড়াশোনা করতে পারে না, স্কুলের সময় ঘুমায়, মাথাব্যথা হয়, মনোযোগে সমস্যা হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, স্কুল থেকে অভিযোগ আসে কিংবা শিশু কথায় কথায় রাগ দেখাতে শুরু করে। ১-৫ বছর বয়সের শিশুদের মাঝেও শতকরা ২৫ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের ঘুমের সমস্যায় ভোগে। ঘুমের সমস্যাগুলো বিভিন্ন মাত্রায়, বিভিন্ন রূপে হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় ভালো হয়।
শিশুদের মাঝে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ঘুমের সমস্যায় ভোগে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো ক্ষণস্থায়ী হয়। কিছু শিশুর ক্ষেত্রে তাদের ঘুমের সমস্যা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড এবং তাদের সার্বিক সুস্থতায় তাৎপর্যপূর্ণ নেতিবাচক প্রভাব রাখে।
বয়স অনুযায়ী প্রতিটি শিশুর দৈনিক কত ঘণ্টা স্বাভাবিক এবং গুণগত মানসম্মত ঘুম প্রয়োজন তা জানা প্রয়োজন।
বয়স অনুযায়ী শিশুর প্রয়োজনীয় ঘুমের সময় তালিকা-
১-৪ সপ্তাহ : ১৬-১৭ ঘণ্টা
১-৪ মাস : ১৬-১৭ ঘণ্টা
৪ মাস-১ বছর : ১৪-১৫ ঘণ্টা
১-৩ বছর : ১২-১৪ ঘণ্টা।
রাতেই বেশি ঘুমায়, দিনে একবার ন্যাপ নেয় অথবা অল্প সময়ের জন্য ঘুমায়।
৩-৬ বছর : ১১-১২ ঘণ্টা
৭-১২ বছর : ১০-১২ ঘণ্টা
১৩-১৮ বছর : ৬-৮ ঘণ্টা
শিশুদের ঘুমের সমস্যাকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়- ডিসসমনিয়া, প্যারাসমনিয়া।
১. ডিসসমনিয়া
এটি ইনসমনিয়া এবং হাইপারসমনিয়া’র মাঝামাঝি অন্তর্ভুক্ত। ডিসসমনিয়া হলো ঘুমাতে যাওয়ার পর সহজে ঘুম না আসা, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া, খুব সকালে ঘুম ভেঙে যাওয়া অথবা একেবারেই ঘুম না হওয়া ইত্যাদি। যা কয়েকদিন থেকে সপ্তাহ, অথবা কয়েক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে চলতে থাকে। যা শিশুর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে, শিশুর মাঝে সতেজ অনুভূতির অভাব তৈরি করে, ফলে শিশুর মাঝে দিনে ঘুম ঘুম ভাব থাকে। মানসিক চাপ, শারীরিক অসুস্থতা (ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগ, অ্যালার্জি বা চুলকানি রোগ, থাইরয়েডের সমস্যা, হাড় এবং মাংসপেশিতে ব্যথা, গলাবুক জ্বলা, দাঁত ব্যথা ইত্যাদি), মানসিক রোগ (ডিপ্রেশন, অ্যানজাইটি), ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি ইনসমনিয়ার কারণ হতে পারে। কিছু স্নায়ুবিকাশজনিত রোগ যেমন অটিজম, এসপারজারস্ সিন্ড্রোম, লার্নিং ডিসএবিলিটি, হাইপারএকটিভিটি ডিসঅর্ডার ইত্যাদিও শিশুদের ইনসমনিয়ার কারণ হতে পারে। আপনজনের (বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, অথবা গুরুত্বপূর্ণ পরিচর্যাকারী) কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয়, স্কুলে পড়ার চাপ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ, বুলিং, ভাই-বোন বা বন্ধুর সঙ্গে কলহ, নতুন স্থানে গমন, নতুন রুটিন ইত্যাদি শিশুদের মানসিক চাপের কারণ হতে পারে এবং তা থেকে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় নির্দিষ্ট কোনো গান, গল্প না শুনলে শিশুর ঘুম আসে না। নির্দিষ্ট কোনো আপনজনের নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে আদর করা, জড়িয়ে ধরা, কোলে নেওয়া ইত্যাদির অভাববোধ করলেও শিশু ঘুমাতে পারে না। এমনটি মাঝে মাঝে হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু তা বেশিদিন চলতে থাকলে অবশ্যই তা ঘুমের সমস্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে হাইপারসমনিয়া হলো রাতে পর্যাপ্ত ঘুমানোর পরও দিনের বেলায় ঘন ঘন ঘুমানো অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকা এবং ক্লান্তবোধ করা, সকালবেলা ঘুম থেকে জাগতে কষ্ট হওয়া। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, নারকোলেপ্সি, রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম ইত্যাদি হাইপারসমনিয়ার কারণ।
২.প্যারাসমনিয়া
ঘুমের বিভিন্ন ধাপে অথবা ঘুমের মাঝে অথবা ঘুম এবং সজাগ অবস্থার মাঝামাঝি পর্যায়ে সংঘটিত কিছু আচরণ বা শারীরবৃত্তীয় কাজের উপস্থিতি থাকলে সেটিকে বলা হয় প্যারাসমনিয়া। যেমন নাইটমেয়ার, নাইটটেরর, স্লিপ ওয়াকিং, ব্রুক্সিসম, স্লিপ ইন্যিউরেসিস, স্লিপ অ্যাপনিয়া, রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম ইত্যাদি।
নাইটমেয়ার :
এটিকে ড্রিম অ্যানজাইটি ডিসঅর্ডার বা স্বপ্নোদ্বেগ রোগও বলা যায়। এক্ষেত্রে শিশু স্বপ্নে এমন কিছু দেখে যা তাকে উদ্বিগ্ন, ভীত এবং অস্থির করে তোলে। ঘুমের রেপিড আই মুভমেন্ট ধাপে এটি হয়। এক্ষেত্রে শিশু রেম স্লিপ থেকে সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় ফিরে আসতে পারে এবং স্বপ্নের বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারে। দিনের বেলায় ঘটে যাওয়া কোনো ভীতিকর অবস্থা থেকে অথবা উদ্বেগজনিত কারণে (পরীক্ষার আগে, আপনজন অসুস্থ থাকলে, কারও কাছ থেকে হুমকি পেলে, ইত্যাদি কারণে) এটি ঘনঘন হতে পারে। ৫-৬ বৎসর বয়সের শিশুদের মাঝে এটি সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপজনিত রোগ, জ্বর, মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ এবং মাদকের প্রত্যাহারজনিত কারণেও এমন হতে পারে।
নাইটটেরর :
এটি নন-রেম স্লিপ-এ ঘটে। ঘুমাতে যাওয়ার ৯০ মিনিট পর অথবা প্রতি ৯০ মিনিট অন্তর অন্তর শিশুর ঘুম ভেঙে যায়। এর ফলে সে শোয়া থেকে ওঠে বসে, কখনো দাঁড়িয়ে যায়, কখনো ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটে, প্রচণ্ড অস্থির এবং আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। কখনো জোরে কান্নাকাটি করে। হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। শিশু বুঝতে পারে না তার কি করতে হবে। তবে কয়েক মিনিটের মাঝেই শিশুটি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায় এবং আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে শিশু স্বপ্নে কি দেখেছে তা মনে করতে পারে না বা করলেও খুব কম মনে করতে পারে। এটি নাইটমেয়ারের চেয়ে কম পরিলক্ষিত হয়। পরিবারে কারও এ রোগ থাকলে বংশগতভাবে হতে পারে। সাধারণত শৈশবে শুরু হয়ে শৈশবে শেষ হয়। তবে কখনো কখনো প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও চলতে থাকে।
স্লিপওয়াকিং :
এক্ষেত্রে শিশু ঘুমের মাঝে হাঁটে। এটি নন-রেম স্লিপের গভীর পর্যায়ে (স্টেজ ৩-৪ ) হয়। সাধারণত রাতের প্রথমার্ধে হয়। ৫-১২ বৎসরের শিশুদের মাঝে সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়। যাদের এ সমস্যা রয়েছে তাদের মাঝে প্রতি ১০০ জনে ১৫ জন শিশু অন্তত একবার ঘুমের মাঝে হাঁটে। মাঝে মাঝে বড় হওয়ার পরও এ সমস্যা থেকে যায়। পারিবারিক বা বংশগতভাবে হতে পারে। ঘুমের মাঝে অধিকাংশ শিশু সত্যিকার অর্থে হাঁটে না। তারা ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় বিছানা থেকে ওঠে দাঁড়ায়, নড়াচড়া করে, সাধারণত চোখ খোলা রেখে চারপাশে হাঁটে, কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না এবং তাদের ঘুম থেকে জাগানো খুব কঠিন হয়। সাধারণত তারা আবার বিছানায় ফিরে যায়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়। এরা রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় কি কি করেছিল তা পরদিন মনে করতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এরা নিজের এবং অন্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ, নিজের অজান্তে নিজের এবং অন্যের জন্য ক্ষতিকারক কিছু করে ফেলতে পারে। তাই তাদের জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেমন; দরজা-জানালা তালাবন্ধ রাখা, ঝুঁকিপূর্ণ জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা ইত্যাদি।
স্লিপ অ্যাপনিয়া :
একজন শিশু যদি ঘুমের মাঝে ১০ সেকেন্ড বা তার বেশি সময় শ্বাস নিতে না পারে তাহলে তা ভীতিকর। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শিশুটি জোরে জোরে নাক ডাকছে, মুখ খোলা রেখে ঘুমাচ্ছে, দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব থাকছে। বেশিরভাগ শিশু জানেই না তারা এমন করছে। শিশুদের মাঝে টনসিল, এডেনয়েড, কানের সংক্রমণের কারণেও রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যায়। দিনের বেলায় ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে; পড়াশোনা এবং অন্যান্য কাজে মনোযোগ দিতে পারে না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ে, আচরণগত সমস্যা, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে হবে।
রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম :
গবেষণা বলছে শিশুদেরও এটি হতে পারে। যদিও এটি বড়দের রোগ হিসাবে পরিচিত। শিশুরা বলতে পারে ‘পা এ পোকা হাঁটছে’ ‘পা ঝিঁঝি করছে’ এমন অনুভূতির কথা। পায়ের মাঝে অস্বস্তি অনুভূতি থেকে রেহাই পেতে তারা বিছানায় ঘনঘন অবস্থান পরিবর্তন করে, আর তাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
স্লিপ ইন্যিউরেসিস বা বেড ওয়েটিং :
শারীরিক কোনো সমস্যা বা রোগ না থাকা সত্ত্বেও পাঁচ বৎসর বয়সের পর যদি কোনো শিশু প্রায় প্রতিদিনই ঘুমের মাঝে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে তাহলে তার স্লিপ ইন্যিউরেসিস আছে বুঝতে হবে। সাধারণত ছেলেদের মাঝে এটি বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ পরিবর্তনের জন্য কন্টিনজেন্সি (শর্তসাপেক্ষ) ম্যানেজমেন্ট বা স্টার চার্ট মেথড ভালো কাজ করে। তাছাড়া, বেল এন্ড প্যাড সিস্টেম সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং কার্যকর। ব্লাডার ট্রেইনিং, ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে পানি, চা, কফি ইত্যাদি না খাওয়া, সন্ধ্যার পর কম পানি খাওয়া, ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ব্লাডার খালি করা ইত্যাদি। সবগুলো পদ্ধতি একসঙ্গে অনুসরণ করলে শতকরা ৯৯ জন রোগী তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি লাভ করে। তাছাড়া ট্রাইসাইক্লিক এন্টিডিপ্রেসেন্টসের মাঝে ইমিপ্রামিন ভালো কাজ করে, যা একজন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী গ্রহণ করা উচিত।
ব্লুক্সিসম :
ঘুমের মাঝে বেশি বেশি দাঁতে দাঁত পিষা, শব্দ করে দাঁত খিঁচা ইত্যাদি। অনেকেই মনে করে পেটে কৃমি হলে এমন হয়। আসলে মানসিক চাপ, উদ্বেগ অথবা দাঁতের কোনো সমস্যা থাকলে এমন হয়। আর এতে ঘুম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। তাই এটিকে ঘুমের সমস্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এতে দাঁত, জিহ্বা, চোয়াল, গালের ভেতরের অংশও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। তাই এ সমস্যাটি গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করতে হবে।
প্রতিটি মানুষের জীবনে ঘুম একটি অত্যাবশ্যকীয় এবং অপরিহার্য বিষয়। শিশুদের জন্য ভালো মানের পর্যাপ্ত ঘুম আরও বেশি প্রয়োজনীয়। কারণ, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্থ হতে পারে। বিভিন্ন প্রকার আচরণগত ও আবেগীয় সমস্যা তৈরি হতে পারে। মনোযোগ ও স্মরণশক্তি কমে যেতে পারে। কর্মদক্ষতা কমে যেতে পারে। শিশু বেশি বেশি খাওয়া শুরু করতে পারে এবং মুটিয়ে যেতে পারে, বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই শিশুদের ঘুমের সমস্যা থাকলে প্রথমত তা শনাক্ত করা খুব জরুরি। এ সমস্যার জন্য দায়ী কারণও খুঁজে বের করতে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের অধীনে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।
মন্তব্য করুন