আহসানুর রহমান রাজীব, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৫ জুন, ২০২৪, ০২:৪৯ এ এম

অনলাইন সংস্করণ

কর্মসংস্থান ও সুপেয় পানির অভাবে উপকূল ছাড়ছে মানুষ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের সুন্দরবন সংলগ্ন মালঞ্চ নদী তীরে বেড়িবাধেঁর পাশে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলে নিয়ে বসবাস সুফিয়া বেগমদের। নদীর তীরে বসতিটি ঘুর্ণিঝড় আইলার পর তিনটি ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ ভাঙনের কারণে নতুন করে ঘর তৈরী করতে হয়েছে। বর্তমানে তাদের এলাকায় কোথাও সুপেয় পানি পাওয়া যায় না। কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। গোছল, রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজ সারতে হয় জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি অথবা দূরের কোন পুকুর থেকে সংগৃহীত পানি দিয়ে। শুধুমাত্র পানির কারণে বিভিন্ন ধরণের চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছে সুফিয়া বেগম।

এই পরিবারটির মতই ঐ এলাকার নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত হাজার হাজার পরিবার একই সমস্যায় ভুগছেন। একদিকে সুপেয় পানির তীব্র সংকট অন্যদিকে দুর্যোগ এলে বেড়িবাঁধ ভেঙে সর্বোস্ব হারাবার শঙ্কা নিয়েই বসবাস তাদের। তবে যাদের আর্থিক অবস্থা একটু ভাল তারা ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে শহরে।

সুফিয়া বেগম বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর পানিতে তলিয়ে যায়। ঘুর্ণিঝড় আম্পানের পর বসতবাড়ি ভেঙে যায়। নতুন করে ঘর করতে উচ্চ সুদে ১০হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এক বছর পর সুদে আসলে ১৫হাজার টাকা শোধ করতে হয়েছে। আবার ঝড় এলে সেটিও থাকবে কি না, সেই শঙ্কা নিয়েই বসবাস করতে হয়। তাছাড়া খাবার পানির কষ্ট পোহাতে হয় সারা বছর ধরে। তিনি বলেন, আমার নিজের কোন জমি নেই এজন্য বাধ্য হয়ে এখানে বসবাস করতে হয়। তবে যাদের এখানে জায়গা জমি আছে তারা সবাই লবন পানি তুলে মাছ চাষ করে। যারা টাকা পয়সার মালিক তারা কেউ এই এলাকায় থাকে না। তাদের সবার শহরে বাড়ি আছে।

মুন্সিগঞ্জ থেকে আরো দক্ষিণে এই উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। গাবুরার চারপাশ ঘিরে রেখেছে খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদ। গাবুরার চকবারা গ্রামে যেতে হয় নীলডুমুর খেয়াঘাট থেকে খোলপেটুয়া নদী পার হয়ে। ঘুর্ণিঝড় আইলায় চকবার গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবনপানি প্রবেশ করে কয়েক মাস ধরে চলে জোয়ার ভাটা। আইলার আগে গ্রামটিতে তিন শতাধীক পরিবারের বসতি থাকলেও বর্তমানে আছে ১২০টি পরিবার। অধিকাংশ পরিবারের মানুষ এই এলাকা ছেড়ে অনত্র চলে গেছে।

এই গ্রামের বাসিন্দা আলতানূর গাজী বলেন, তাদের গ্রামে ঘূর্ণিঝড় আইলার আগে প্রচুর ধান চাষ হলেও এখন পুরোটাই লবনপানির চিংড়ি চাষ হয়। গ্রামটির কোথাও মিস্টিপানির উৎস নেই। দেড় কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন স্থানীয়রা। এছাড়া সরকারি বে-সরকারি সংস্থা কর্তৃক প্রাপ্ত প্লাস্টিকের ট্যাংকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করেন অনেকে। এই অল্প পরিমাণ পানি দিয়ে জীবন ধারণ খুবই কষ্টসাধ্য। এখানকার পানি অতিমাত্রায় লবনাক্ত হওয়ার কারণে নানা ধরণের চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় বাধ্য হয়ে অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে গেছে। যাদের উপায় নেই তারাই এখানে রয়েছে। এখানে যারা বসবাস করছে তাদের সবাই সুন্দরবন ও নদীতে মাছ শিকারের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া যাদের জায়গা জমি আছে তারা সবাই লবণপানির মাছ করছে।

সাতক্ষীরার আরেক উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনির চিত্রও একই রকম। ঘুর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের সময় নদীর বাঁধ ভেংঙে প্রতাপনগ ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রামে ৬মাস ধরে জোয়ার-ভাটা হয়েছে। বাঁধটি সংস্কার করা হলেও সেখানকার মানুষ এখনও নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে আতঙ্কে থাকে।

আশাশুনির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য তৌসিকে কাইফু বলেন, আশাশুনি উপজেলার কিছু বাঁধ নতুন করে নির্মাণ করা হলেও অধিকাংশ এলাকায় বেড়িবাঁধ ঝুকিতে আছে। তিনি বলেন, আমাদের এলাকার মানুষের অভাব নেই তবে আতঙ্ক আছে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভাঙনের। কারণ বাঁধ ভাঙলে ঘের ও খাবার পানির উৎস নষ্ট হয়ে যায়। লোকালয়ে লবনপাণি প্রবেশ করলে মানুষ সর্বশান্ত হয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমাদের দাবি একটাই বাঁধ ভাঙলে ত্রাণ দরকার নেই। আমাদের দরকার টেকসই ও স্থায়ী বেড়িবাঁধ।

শ্যামনগরের স্বোচ্ছাসেবী সংস্থা সিডিওর পরিচালক গাজী আল ইমরান বলেন, উজানের পানি না আসায় এই এলাকার নদীর পানিতে লবণাক্তার মাত্রা বেশি, এজন্য  এখানকার জমিতে ধান বা অন্য ফসল হয় না। মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান নেই। বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা প্রধান উৎস নদীতে রেণুপোনা সংগ্রহ, মাছ ও কাঁকড়া ধরা। তিনি বলেন, উপকূলবাসীর এলাকা ছাড়ার প্রধান কারণ সুপেয় পানি ও বেড়িবাধেঁর পাশে বসবাসের অনিশ্চয়তা। এই এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ হলে মানুষ এলাকা ছাড়ত না।

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব, অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকার চিত্র বদলে গেছে। উপকূলের এক সময়কার সমৃদ্ধ গ্রামগুলো এখন মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। সেখানে অপরিকল্পতিভাবে চিংড়ি চাষ করতে বাধ কেটে লবনপানি প্রবেশ করিয়ে ফসলের মাঠগুলো ধংস করা হয়েছে। প্রায় প্রতি বছর ঐ এলাকার উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবনপানি প্রবেশ করছে। আইলা, ফণি, মহাসেন, আম্পান ইয়াসেরর আঘাতে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। এসব এলাকার অনেক পরিবার জমি ও সম্পদ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। লবণাক্ততার কারণে উপকূলের মানুষদের খাওয়ার পানির জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়।

তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকায় এখনই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হলে নতুন নতুন এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করবে। এছাড়া সুপেয় পানির ব্যবস্থাসহ বিকল্প কর্মসস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে মানুষ ঐ এলাকা ছেড়ে শহরমুখি হবে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, উপকূলবাসীকে রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এক হাজার ২০কোটি টাকা ব্যায়ে গাবুরা ইউনিয়নের চারপাশে ২৯কি.মি টেকশই বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। যেটির ২৫ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২০২৫ সালে জুন মাসের মধ্যে বাধেঁর কাজ শেষ হবে। সেটি শেষ হলে গাবুরার চিত্র বদলে যাবে।

তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে অন্য এলাকার বাঁধগুলোর নির্মাণ কাজও শুরু হবে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় চাষাবাদ ও খাবার পানি সংরক্ষণের জন্য খাল খনন, পুকুর খনন, আধুনিক পানির প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে প্লাস্টিকের ট্যাংকি বিতরণসহ একাধিক প্রকল্প চলমান আছে।

মন্তব্য করুন