
প্রকাশিত: ১১ জুন, ২০২৪, ০৬:৩২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
কুষ্টিয়ার কুমারখালী জগন্নাথপুর ইউনিয়ন গ্রামীণ মেলার অনুমতি নিয়ে এসে চালাচ্ছেন রমরমা র্যাফেল ড্রয়ের লটারি ব্যাণিজ্য। মেলা শুরুর দিন থেকেই চলছে এই অবৈধ র্যাফেল ড্র এর নামে ডেইলি লটারি ব্যবসা। এই অবৈধ র্যাফেল ড্রই এখন এই মেলার মূল বিষয়ে পরিনত হয়েছে। চটকদার সব বিজ্ঞাপন প্রচার করে এবং মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন রকম পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে ব্যাটারিচালিত ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে করে শতাধিক লাটারি বিক্রেতা কুমারখালী উপজেলা পাশ্ববর্তী খোকসা উপজেলা, রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামসহ কুমারখালী পৌর এলাকা চষে বেড়াচ্ছে র্যাফেল ড্র এর লটারি বিক্রি করতে।
চটকদার এসব বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে মোটরসাইকেল, সাইকেল, টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন রকম পুরস্কার পাওয়ার আশায় গ্রামের নিরীহ নারী পুরুষ প্রতিদিনই এই লটারি কিনছেন। এভাবেই র্যাফেল ড্র এর নামে প্রতিদিন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন মেলার আয়োজক ও র্যাফেল সংশ্লিষ্টরা। এতে আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
এর আগে এই মেলা থেকেই র্যাফেল ড্র এর লটারি বিক্রি করে পুরস্কার না দিয়ে রাতের আঁধারে ১০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালানোর অভিযোগ রয়েছে একটি র্যাফেল ড্র কোম্পানি ও আয়োজকদের বিরুদ্ধে। এর পর বেশ কয়েক বছর র্যাফেল ড্র বন্ধ থাকলেও আবার গ্রামীণ মেলার নামে র্যাফেল ড্র এর আয়োজন করেছে এই মেলার আয়োজকরা।
এদিকে কয়েকদিন ধরে গ্রাম, শহর ও শহরের আশে পাশের মোড়ে মোড়ে প্রকাশ্যে ব্যাটারিচালিত ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক থামিয়ে মাইকে বিজ্ঞাপন প্রচার করে দৈনিক রুপসী বাংলা র্যাফেল ড্র নামের অবৈধ এসব দৈনিক র্যাফেল ড্র এর লটারি বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া এই র্যাফেল ড্র এর লটারির ড্র অনুষ্ঠান প্রতিদিন সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে কুষ্টিয়ার কেবল টিভি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। কিন্তু এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে চললেও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নিরব ভূমিকা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চাঁপাইগাছি এলাকায় চলছে ঐতিহ্যবাহী চাপাইগাছি গাজী কালু চম্পাবতীর মেলা। মেলার পেছনের দিকে র্যাফেল ড্র এর মঞ্চে সাজিয়ে রাখা হয়েছে টিভি ফ্রিজ, সাইকেলসহ নানা রকম পুরস্কার। মাইকে লাগাতার বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এই মঞ্চের সামনেই টেবিল চেয়ার পেতে গোল গোল বাক্স নিয়ে লটারি বিক্রি করছেন একাধিক লটারি বিক্রেতা। এখান থেকে লটারি কিনছেন শিশুসহ অনেকেই।
এছাড়াও কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের মহেন্দ্রপুর, হাসিমপুর, তারাপুর, কুমারখালী শহরের বাসস্ট্যান্ড, বাটিকামারা, কাজীপাড়া মোড়, গণমোড়, হলবাজার, দূূর্গাপুর, সেরকান্দী, আালাউদ্দিন নগর, খোকসা উপজেলার বাসস্ট্যান্ড, কমলাপুর, সোমসপুর, সেনগ্রাম, কালিতলা, গোপগ্রাম, আমবাড়িয়া, খোকসা খেয়াঘাট, রাজবাড়ী জেলার পাংশার বাহাদুরপুর, হাবাশপুর এলাকার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ব্যাটারিচালিত ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক থামিয়ে মাইকে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে মোটরসাইকেল, সাইকেল, টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন রকম পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে জান র্যাফেল ড্র নামের অবৈধ এসব দৈনিক র্যাফেল ড্র এর লটারি বিক্রি করা হচ্ছে। মাইকে এসব লোভনীয় বিজ্ঞাপন শুনে লটারি কিনতে পিকআপ, ব্যাটারিচালিত ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে থাকা লটারি বিক্রেতাদের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষরা। কেউ কেউ ২০ টাকা মূল্যের এই লটারি ৩ থেকে ৪ টিও কিনছেন। কোনো কোনো ব্যক্তি আবার ৭/৮টি লটারিও কিনছেন।
ইজিবাইক চালক মো. লিপু হোসেন নামের এক লটারি ক্রেতা জানান, একটা ফ্রিজের আশায় প্রতিদিন তিনি ৯/১০টি লটারির টিকেট কেনেন এতে তার প্রতিদিন ১শ ৮০ থেকে ২ শ টাকা খরচ হয়। যা আয় করছেন তার অর্ধেক লটারি কিনতে খরচ করছেন। তবুও তিনি প্রতিদিন লটারি কেনেন এবং যত দিন এই লটারি চলবে তিনি ততোদিন লটারি কিনবেন। লটারি কেনা তার কাছে এক প্রকার নেশার মতো হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লটারি বিক্রেতা জানান, যেখানেই এমন র্যাফেল ড্রয়ের আয়োজনসহ মেলা হয় মেলার আয়োজকরা একটা চুক্তির মাধ্যমে লটারি কোম্পানিকে ডেকে নিয়ে যায়। র্যাফেল ড্র এর লটারি বিক্রি টাকার ভাগ মেলার আয়োজক ও লটারি কোম্পানি ভাগাভাগি করে নেয়। চাপাইগাছি গাজী কালু চম্পাবতীর মেলায় এবার ১১৩ জন লোক লটারি বিক্রি করছেন। তাদের প্রতিজনকে প্রতিদিন ৫শ টাকা মজুরি ও ২৫০ টাকা খাবার জন্য এবং প্রতিটি ভ্যান বা ইজিবাইক ভাড়া বাবদ ৭০০ টাকা দেওয়া হয়। প্রতিজন বিক্রেতার হাজিরাসহ ব্যাটারিচালিত ভ্যান বা ইজিবাইক ও মাইক ভাড়া মিলিয়ে প্রতিটিতে ১৬ থেকে ১৭শ টাকা করে খরচ হয়। প্রতিটি ভ্যান বা ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন সাড়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার লটারি বিক্রি হয়।
এ বিষয়ে মেলা কমিটির সভাপতি ও জগন্নাথপুর ইউপি সদস্য নাসির আহমেদ খোকন বলেন, আমাদের ওইভাবে র্যাফেল ড্রয়ের অনুমোদন নেই। মেলায় প্রবেশের টিকেটের ওপর লটারি করার অনুমোদন আছে।
তাহলে কিভাবে বিভিন্ন এলাকায় ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত ভ্যানে মাইকিং করে লটারি বিক্রি করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমি বলতে পারবো না। আমরা ছোট মানুষ মেলা লাগায় নেতারা তারাই এটা সঠিক বলতে পারবে। এব্যাপারে আপনি একটু সাবেক চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে নিয়েন।
এ ব্যাপারে কুষ্টিয়া জেলা প্রেসক্লাবের সহসভাপতি মজিবুল শেখ দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকো বলেন, গ্রামীণ মেলা বাঙালীর ইতিহাস ঐতিহ্য ধারণ করে। এই গ্রামীণ মেলা হলে কোন অসুবিধা নেই তবে এই মেলার নামে লটারি জুয়ার আয়োজন চলতে পারেনা। এই সময়ে গ্রামেগঞ্জে ফসল উঠছে সেই ফসল বিক্রি করে কিছু মানুষ মেলায় চলা র্যাফেল ড্রয়ের নামে লটারি জুয়ায় আশক্ত হয়ে পড়ছে। সুধু এরাই নয় এর ফলে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকাশ্যে এমন লটারির নামে জুয়ার আয়োজন চললেও এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিরব এটা লজ্জাজনক। এই নিরবতা সাধারণ মানুষের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের সৃষ্টি করে। এটা অতিদ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত।
এব্যাপারে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিভিন্ন শপিং মলে যেমন দোকানীরা পন্য বিক্রির মাধ্যমে লটারি বিক্রি করে থাকেন ঠিক তেমনভাবে র্যাফেল ড্রয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মেলার লটারি ইজিবাইক ভ্যানে করে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বিক্রি করতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, এভাবে লটারি বিক্রি করতে পারবে না, এমনভাবে লটারি বিক্রির অনুমোদন মেলা কমিটিকে দেওয়া হয়নি।
এব্যাপারে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুয়ার লটারির কোন অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এ বিষয়টি আমরা দেখবো।
মন্তব্য করুন