
প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বার, ২০২৫, ০৯:৩৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
লেখক: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী:
ঢাকার হৃদয়ে, শহীদ মিনারের পাশেই নিভৃত সমাধিতে শুয়ে আছেন এক আল্লাহওয়ালা—হযরত শাহ সুফি নবী বক্স (রহ.)। তিনি ছিলেন ইরফানী পথে দীপ্ত, রূহানী রিয়াজতে সমুন্নত, তাসাউফী মহিমায় আলোকিত। পৃথিবী তাঁকে চিনেছিল এক সাধারণ মানুষের বেশে; অথচ অন্তরে তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বন্ধু।
উনিশ শতকের শেষভাগে বিহারের ছাপড়া থেকে আগমন এই নগরীতে। খাটো দেহ, শ্যামবর্ণ চেহারা—বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনো বিশেষত্ব ছিল না। কিন্তু তাঁর চোখের দৃষ্টি, চলার ভঙ্গি, নীরবতার গভীরতা মানুষকে টেনে নিত। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে এক তামাকের দোকানে কর্মচারী হয়ে শুরু হয় তাঁর পথচলা। সততা, ধৈর্য, ন্যায়পরায়ণতা আর এক ধরনের গম্ভীর রূহানী আভা ক্রমশ মানুষকে মুগ্ধ করতে থাকে।
একসময় তিনি দোকান ছেড়ে চলে আসেন রমনার প্রান্তে, রেসকোর্স মাঠের আমগাছতলে। আকাশের নীচে বিছানা, বাতাসে জিকিরের সুর, মাটিতে সেজদাহ—এভাবেই কেটে যেত তাঁর রাত। ধীরে ধীরে সেই গাছতলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক রূহানী আস্তানা। ভক্ত-অনুরাগীরা ভিড় জমাতেন, সান্ত্বনা খুঁজতেন, আর খুঁজে পেতেন এক তাসাউফী প্রশান্তি।
শাহ সুফি নবী বক্স (রহ.)-এর বিশেষ পরিচয় হয়ে ওঠে তেল। নিজের মাথায় ঢেলে নিতেন, অন্যের মাথায় মালিশ দিতেন, অসুস্থকে তেলপড়া পান করাতেন। অনেকে শেফা পেতেন, কেউ আবার অশান্ত হৃদয় নিয়ে এসে শান্তি নিয়ে ফিরতেন। ব্যবসায়ীরা হাঁড়ি-পাতিল বা তেল তাঁর হাতে সমর্পণ করে নিজেদের কাজ শুরু করতেন। ভালোবাসা থেকেই মানুষ তাঁকে ডাকত “তেলশাহ”—কিন্তু প্রকৃত পরিচয় তো ছিল অনেক গভীর; তিনি ছিলেন এক ওলি আল্লাহ, আল্লাহর প্রিয় বান্দা।
তিনি কখনো দুনিয়াবি কোনো লোভে পড়েননি। কেউ কিছু চাইলে বলতেন—“আমার কাছে কিছু নেই।” অথচ তাঁর দোয়ার ছোঁয়ায় বহু মানুষ ভাগ্যবান হয়েছেন। আসলে তাঁর “আমার কাছে কিছু নেই” বলার মধ্যে ছিল এক গভীর ইরফানী শিক্ষা—সবকিছুই আল্লাহর, বান্দার কিছুই নেই।
১৯৪৩ সালের এক রাতে তাঁর দুনিয়াবি সফর শেষ হয়। ব্রিটিশ সেনারা তাঁকে স্থান ত্যাগ করতে বললে তিনি কেবল বলেছিলেন—“ঠিক আছে, কাল চলে যাব।” সত্যিই পরদিন ভোরে তিনি চলে গেলেন—তবে গন্তব্য হলো চিরস্থায়ী রূহানী মঞ্জিল। আমগাছের তলাতেই দাফন করা হলো তাঁকে। জানাজায় ঢাকার অগণিত মানুষ অংশ নিল; শহীদ মিনারের চত্বর হয়ে উঠল দোয়া ও কান্নার ময়দান।
তাঁর ইন্তেকালের নয় বছর পর, ১৯৫২ সালে এখানেই আরেক ইতিহাস রচিত হয়—ভাষার দাবিতে তরুণরা প্রাণ দিলেন। এভাবে তাঁর সমাধিক্ষেত্র মিশে যায় জাতির আত্মত্যাগের ইতিহাসের সঙ্গেও।
আজও প্রতিটি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁর মাজারে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল হয়। আর রজব মাসের ১৩ তারিখে পালিত হয় বার্ষিক ওরস। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার ২০১৮ সাল থেকে মাজার খুলে দেওয়া হয়, যাতে ভক্তরা আসতে পারেন এই ওলির সান্নিধ্যে।
হযরত শাহ সুফি নবী বক্স (রহ.) কোনো কিতাব লিখে যাননি, কোনো বাহ্যিক দাওরাও গড়ে তুলেননি। রেখে গেছেন শুধু এক ইরফানী শিক্ষা—সত্যিকারের আল্লাহওয়ালার পরিচয় প্রাসাদে নয়, বরং মাটির গন্ধে, নীরব সেজদায়, রিয়াজতের আলোয়, আর মানুষের ভালোবাসায়।
সূত্র: মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাকার ইতিহাস (১৫৯৯–২০১২)
মন্তব্য করুন